ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস অনুযায়ী, মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এসব কিতাবের মধ্যে তাওরাত, যা হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল, অন্যতম। মুসলিম উম্মাহর কাছে কুরআনের পরেই তাওরাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কারণ এটি ইসলামপূর্ব নবীদের জন্য আল্লাহর বিধানসংবলিত এক মহান গ্রন্থ। অনেক ইসলামি বর্ণনা অনুসারে, তাওরাত রমজান মাসেই নাজিল হয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা তাওরাত নাযিল হয় কততম রমজানে, এর গুরুত্ব এবং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাওরাত কী?
তাওরাত মূলত ‘তোরাহ’-এর আরবি নাম। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি ছিল হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব, যা বনি ইসরাইল জাতির জন্য হিদায়াতের উৎস ছিল। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত প্রথম প্রধান আসমানি কিতাব। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাওরাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং একে সত্যের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তাওরাত কবে নাজিল হয়েছিল?
হজরত মুসা (আ.)-এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, হাজার বছর আগে রমজান মাসের ৬ তারিখে আল্লাহ তাআলা তাঁকে আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ পাথরের ফলকে লিখে দিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গিয়ে প্রথমে ৩০ দিন রোজা ও ইতিকাফ করেন, এরপর আরও ১০ দিন একইভাবে এই পদ্ধতি অব্যাহত রাখেন। মোট ৪০ দিন পর তিনি ‘তাওরাত’ প্রাপ্ত হন। তাঁর এই সফর শুরু হয়েছিল ২৭ রজব থেকে, এবং ৬ রমজানে ৪০ দিন পূর্ণ হলে তিনি আল্লাহর বাণী লাভ করেন। হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি কথা বলার কারণে তিনি ‘কালিমুল্লাহ’ খেতাবে অভিষিক্ত হন। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে যে, “মুসার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছিলেন।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৪)
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহকে দেখার জন্য আকুল আবেদন জানান। আল্লাহ বলেন, “তুমি আমাকে কখনো দেখতে পারবে না। তবে পাহাড়ের দিকে তাকাও; যদি তা স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।” যখন আল্লাহ পাহাড়ে জ্যোতি প্রদর্শন করেন, তখন পাহাড় ভেঙে যায় এবং মুসা জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি বললেন, “মহিমাময় তুমি, আমি তোমার কাছে ফিরে আসলাম এবং আমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৪৩)
হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে ছিল একটি আশ্চর্য লাঠি, যা অনেক মুজিজার অধিকারী ছিল। ফিরআউনের জাদুকরদের যাদুর সাপ সেই লাঠির মাধ্যমে গিলে ফেলেছিল। আল্লাহ বলেন, “মুসাকে বললাম, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর; তা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১১৭) এই লাঠি লোহিত সাগরে বিশাল পথ তৈরি করেছিল, যার মাধ্যমে হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করে নীল নদের ওপারে নিয়ে যান। এই লাঠি অন্ধকারে আলোর কাজ করত, অনাবৃষ্টিতে পানি বর্ষণ করত, এবং ফলমূল ও মিষ্টি দান করত।
হজরত মুসা (আ.)-এর রিসালাতের সময় তিনি ১০টি ধর্মীয় বিধান লাভ করেন, যার মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, মূর্তি তৈরি করবেন না, মাতা-পিতার অবাধ্য হবেন না, হত্যা করবেন না, ব্যভিচার করবেন না, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না, প্রতিবেশীর পরিবারের প্রতি অন্যায় লালসা করবেন না” ইত্যাদি। হজরত মুসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর সাক্ষাৎ এবং বিশেষ জ্ঞান শিক্ষালাভের বিষয়েও কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, “অতঃপর তারা (মুসা ও তাঁর সঙ্গী) আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের (খিজির) সাক্ষাৎ পেল, যাকে আমি বিশেষ জ্ঞান দান করেছি।” (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ৬৫-৬৬)
মাহে রমজানে আল্লাহ প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ছিল হিব্রু, এবং ‘তাওরাত’ এই ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, “আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় পাঠিয়েছি।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪)
নবী করিম (সা.) বলেছেন, “রমজান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ জিনিস দেওয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেওয়া হয়নি।”
হজরত মুসা (আ.)-এর সময়ে রোজার বিধান ছিল। ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে শনিবার এবং মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা ফরজ ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা অবস্থায় দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেন রোজা রেখেছ?” তারা বলল, “এটি সেই মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে মুক্ত করেছিলেন।” এই কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, “আমি তোমাদের চেয়ে হজরত মুসা (আ.)-এর নিকটবর্তী।” এরপর তিনি সেই দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে ‘তাওরাত’ পাওয়ার পূর্বে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি সেখানে ৪০ দিন রোজা অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। তাই ইহুদিরা ৪০টি রোজা রাখাকে ভাল মনে করত, বিশেষ করে ৪০তম দিনে রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। আশুরার দিনে হজরত মুসা (আ.) ১০টি বিধান পেয়েছিলেন, তাই ওই দিনের রোজার জন্য তাগিদ রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সেহরি খাওয়া।” (মুসলিম)
আসমানি কিতাবগুলোর নাজিলের তারিখ
হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, ইসলামি ঐতিহ্যে চারটি প্রধান আসমানি কিতাব রমজান মাসে নাজিল হয়েছে:
তাওরাত – ৬ই রমজান
জবুর – ১২ই রমজান
ইঞ্জিল – ১৮ই রমজান
কুরআন – ২৪শে রমজান (লাইলাতুল কদরে)
এ থেকে বোঝা যায় যে রমজান মাস আসমানি কিতাবগুলোর নাজিলের মাস হিসেবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
তাওরাতের শিক্ষা ও গুরুত্ব
তাওরাতে প্রধানত ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি, নৈতিক শিক্ষা ও বনি ইসরাইলের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে দানকৃত বিধান, যা তৎকালীন সমাজের শৃঙ্খলা ও আলোর পথ দেখিয়েছিল। কুরআনে তাওরাতের উল্লেখ রয়েছে এবং হজরত মুসা (আ.)-কে এই কিতাবের প্রধান অনুসারী বলা হয়েছে।
তাওরাতের বিকৃতি ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ
ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, তাওরাত নাজিলের পর কালের বিবর্তনে এতে বিকৃতি সাধিত হয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব স্বার্থে তাওরাতের অনেক অংশ পরিবর্তন বা সংযোজন করেছে। তাই, ইসলামের দৃষ্টিতে বর্তমানে প্রচলিত তাওরাত আর মূল আসমানি গ্রন্থের সাথে পুরোপুরি মিল নেই। কুরআনে বলা হয়েছে:
"তারা আল্লাহর বাণী বিকৃত করে এবং তা ভুলভাবে উপস্থাপন করে।" (সুরা আল-মায়েদা: ১৩)
এই কারণে ইসলাম মুসলমানদের জন্য কুরআনকেই চূড়ান্ত ও সংরক্ষিত আসমানি কিতাব হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
তাওরাত ও কুরআনের সম্পর্ক
ইসলামে তাওরাতের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়নি, বরং কুরআনে একে আল্লাহর দেয়া হিদায়াত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তবে কুরআন তাওরাতের চূড়ান্ত পরিশুদ্ধ ও সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে এসেছে, যা সমস্ত মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত বিধান। কুরআন অনুসারে, ইসলাম আগের সব আসমানি কিতাবের সমর্থনকারী ও পরিপূর্ণতা দানকারী গ্রন্থ।
শেষকথা, তাওরাত ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আসমানি কিতাব, যা রমজান মাসের ছয় তারিখে হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে নাজিল হয়েছিল। এটি বনি ইসরাইলের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা হিসেবে এসেছে। তবে কালের পরিক্রমায় এতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা কুরআন দ্বারা সংশোধিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মে তাওরাতের প্রতি সম্মান দেখানো হলেও মুসলমানদের জন্য কুরআনই চূড়ান্ত গ্রন্থ। তাই মুসলমানরা কুরআনকে মূল পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করে এবং পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোর প্রকৃত শিক্ষাকে সম্মান করে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর/FAQ
প্রশ্ন: তাওরাত কিতাব কখন নাজিল হয়?
উত্তর: তওরাত কিতাব হযরত মূসা (আ.) এর ওপর নাযিল হয়েছিল। এটি পবিত্র রমজান মাসে নাজিল করা হয়। তওরাত ছিল بني اسرائیل জাতির জন্য আল্লাহর বিধান ও নির্দেশনা। এতে তাওহিদ, শরিয়ত ও নৈতিকতার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: তাওরাত কোন মাসে নাযিল হয়?
উত্তর: তওরাত পবিত্র রমজান মাসে হযরত মূসা (আ.) এর ওপর নাযিল হয়। এটি ছিল بنی اسرائیল জাতির জন্য আল্লাহর নির্দেশিকা।
প্রশ্ন: কোন কোন কিতাব কোন কোন নবীর উপর নাযিল হয়েছে?
উত্তর: আসমানি কিতাব চারটি এবং সেগুলো নিম্নলিখিত নবীদের ওপর নাযিল হয়েছে:
১. তওরাত – হযরত মূসা (আ.)
২. যবূর – হযরত দাউদ (আ.)
৩. ইনজিল – হযরত ঈসা (আ.)
৪. কুরআন – হযরত মুহাম্মদ (সা.)
প্রশ্ন: আসমানি কিতাব কয়টি?
উত্তর: আসমানি কিতাব মোট চারটি: তওরাত, যাবূর, ইনজিল ও কুরআন। এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থ।